আইরিন সোলতানা রুমি, নিজস্ব প্রতিবেদক ::
সরকারি কোন অনুমোদন ছাড়াই লামার ফাইতং ইউনিয়নের ২৪টি অবৈধ ইটভাটা সহ উপজেলার ৩১টি ইটভাটা বিনাবাধায় বহাল তবিয়তে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ইটভাটায় ইট প্রস্তুত কাজে পাহাড় কেটে মাটি সংগ্রহ ও জ্বালানি হিসেবে বনজ সম্পদ উজাড় করা হচ্ছে নির্বিচারে।
এইসব ইটভাটার কাজে মাটি সংগ্রহ করতে গিয়ে ইতিমধ্যে ২ শতাধিক ছোট-বড় পাহাড় ইতিমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন, লামার ফাইতং ও ফাঁসিয়াখালী এলাকার লোকজন। অপরদিকে ইটভাটার বিশাল পরিমাণের জ্বালানি সংগ্রহ করতে গিয়ে বৃক্ষশূণ্য হয়ে পড়ছে ছোট-বড় শতাধিক পাহাড়ি ।
সরজমিনে লামার ফাইতং এলাকার ঘুরে দেখা যায়, এই ইউনিয়নের ২৪টি ইটভাটার ইট পরিবহন, মাটি ও জ্বালানী লাকড়ি সংগ্রহ কাজে ব্যবহৃত ভারী ট্রাকের কারণে রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট ভেঙ্গে চরম বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছে গ্রামীণ অবকাঠামো। পাহাড়ি গ্রাম রাইম্যাখোলা, শিবাতলী পাড়া, মংব্রাচিং কারবারী পাড়া, ফাদু বাগান পাড়া, হেডম্যান পাড়া ও বাঙ্গালি পাড়ার অধিবাসীরা জানান, ইটভাটার অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে বান্দরবান জেলা প্রশাসকের বরাবর আবেদন করেও প্রতিকার পায়নি।
বনজ সম্পদ ব্যবহারের সহজ লভ্যতা ও দূর্বল প্রশাসনিক তদারকির কারণে ফাইতং ইউনিয়ন অবৈধ ইটভাটা স্থাপনের নিরাপদ জোনে পরিণত হয়েছে। এক নাগারে ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কারণে স্থানীয় অধিবাসীদের মাঝে শ্বাসকষ্ট প্রদাহ জনিত রোগ, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
দিনের পর দিন বদলে যাচ্ছে পাহাড়ি এলাকা ফাইতংয়ের চেহারা। উঁচু উঁচু পাহাড়গুলো সমতল হচ্ছে। বৃক্ষগুলো উজাড় হতে হতে মরুময় হয়ে গেছে পুরো এলাকা। ভরাট হয়ে গেছে ছোট ছোট পাহাড়ি ছড়া ও খাল। কোথাও ফসলি জমি নেই। ফলের বাগান নেই। নেই বৃক্ষবাগান। বিরানভূমিতে রূপ নিয়েছে এই জনপদ।
বিশেষ করে ইউনিয়নের শিবাতলী পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘেঁষে গড়ে ওঠেছে ৩টি ইটভাটা। দুটি ভাটার মালিক বেলাল হোসেন ও অন্যটি মোহাম্মদ হুমায়ুনের। স্কুলটির প্রধান শিক্ষক মো. নেজাম উদ্দিন বলেন, বিদ্যালয়টি পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। ইটভাটার মালিকরা স্কুলের চারপাশ ও খেলার মাঠের মাটি কেটে নিয়ে গেছে। শুধুমাত্র ভবনটি টিকে আছে কোনমতে। তারই মাঝে ভিতরে বসে ধোঁয়ার চোখ পোড়ানোর সঙ্গে যুদ্ধ করছে চলছে কোমলমতি শিশুদের লেখাপড়া।
উপজেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, এই বছর লামার ফাইতং এলাকায় ২৪টি, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নে ৪টি, লামা পৌরসভায় ১টি, গজালিয়ায় ১টি ও সরই ১টি সহ মোট ৩১টি ব্রিকফিল্ড রয়েছে। কোনটিরই সরকারী অনুমোদন বা লাইসেন্স নেই।
জানা গেছে, চরম পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে ফাইতং-এ ২০১৫ সালে পাহাড়ধসে ১৩ জনের মৃত্যু হয়। কিন্তু তাতেও টনক নড়েনি কারো। ইটভাটাকে নিরুৎসাহিত করতে ভূমিকা নিচ্ছে না স্থানীয় প্রশাসন। কয়েক গজের মধ্যেই পুলিশ ফাঁড়ি, বন বিভাগের বিট অফিসারের কার্যালয়, ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়। কিন্তু বন ও পাহাড় ধ্বংসের এমন হরিলুটের মাঝখানে বসে তারা নীরব ভূমিকা পালন করছেন। মাঝে মাঝে লোক দেখানো ভ্রাম্যমাণ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জরিমানা আদায় করা হয়।
২০১৬ সাল থেকে ফাইতংয়ের ইটভাটা মালিকরা কৌশলী হয়েছেন। ট্রেড লাইসেন্স, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র এবং ইটভাটার জন্য জেলা প্রশাসনের কোনো লাইসেন্স না নিলেও সরকারকে খুশি রাখতে তাঁরা ভ্যাট পরিশোধ করা শুরু করেছেন। ২০১৭ সালেও ভাটাপ্রতি ৩ লাখ ৯৮ হাজার টাকা করে ভ্যাট জমা হয়েছে ভ্যাট বিভাগে। বান্দরবান ভ্যাট অফিসের তথ্য অনুযায়ী এই বিভাগে দুটি সার্কেলে রয়েছে। সব মিলিয়ে এবার তাঁরা বান্দরবানের ৪৬টি ইটভাটার কাছ থেকে মোট ১ কোটি ৮২ লাখ ১৬ হাজার টাকার ভ্যাট আদায় করেছে।
ট্রেড লাইসেন্স বা অনুমোদন বিহীন ইটভাটা মালিকরা কীভাবে ভ্যাট নিবন্ধন করেছেন জানতে চাইলে বান্দরবান ভ্যাট অফিসের সুপারভাইজার বলেন, ‘কেউ নিজ থেকে নিবন্ধন না করলে ফোর্সলি নিবন্ধন করার বিধান আছে।
ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি কবির আহমদ জানিয়েছেন, নভেম্বর মাসের শেষের দিক থেকে ইটভাটায় আগুন দেয়া হয় আর চলে মে-জুন মাস পর্যন্ত। আমাদের সরকারী অনুমোদন নেই তবে হাইকোর্টের একটি রিট মূলে ১৩টি ব্রিকফিল্ড চলছে। অন্য গুলো কিভাবে চলে আমি জানিনা। পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে বনের কাঠ পুড়ানো হচ্ছে।
ফাইতং ইউপি চেয়ারম্যান মো. জালাল আহমদ জানিয়েছেন, স্থানীয় ভূমি মালিকদের কাছ থেকে জমি লিজ বা ক্রয় করে ফাইতং ইউনিয়নে ইট ভাটা করা হচ্ছে। ২০১৫ সালে ফাইতং ইউনিয়নের ইটভাটাগুলোকে ব্যবসায়িক সনদ (ট্রেড লাইসেন্স) দেওয়া হলেও পরিবেশ বিনষ্টের আশঙ্কা এড়াতে ২০১৬ থেকে অদ্যাবধি কোন ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করা হয়নি।
লামা হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ মোঃ শফিউর রহমান মজুমদার জানিয়েছেন, পরিবেশের এই বিরূপ প্রভাব রোধ করা না হলে স্থানীয় জনসাধারন আরও জটিল রোগে আক্রান্ত হবে। লামা বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন আহমদ জানান, বায়ুদূষণের কারণে বিভিন্ন ফলদ বাগানের ফলন কমে যাবে। বনজ বাগান লাল হয়ে চারা/গাছ মারা যাবে এবং উল্লেখযোগ্য হারে বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হবে।
লামার দায়িত্বরত পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মো. মুকবুল হোসেন জানিয়েছেন, বান্দরবান জেলায় সরকারের অনুমোদন প্রাপ্ত কোন ইট ভাটা নাই। পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ইট ভাটা স্থাপনের জন্য কোন ছাড়পত্র প্রদান করা হয় নাই।
বান্দরবান জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক চকরিয়া নিউজ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, অবৈধ ইট ভাটার বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে নিয়মিত মোবাইল কোট পরিচালনা করা হচ্ছে এবং ইটহবে।
পাঠকের মতামত: